আহসান সুমন:
পৃথিবীতে ভালবাসাবাসি মানুষদের বিয়োগান্তিক বহু বিরল ঘটনা রয়েছে। লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ আর মমতাজের প্রতি স¤্রাট শাহজাহানের অমর প্রেম কাহিনী প্রজন্মের কাছে এখনো কালের সাক্ষি। তেমনি এক বিরল অমর প্রেমগাঁথা “মাথিনের কূপ”। যে কূপটির অবস্থান দেশের সর্ব দক্ষিনের সীমান্ত জনপদ কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায়।

শত বছর আগের কথা। ধীরাজ ভট্টাচার্য নামে এক সুদর্শন পুলিশ কর্মকর্তা বদলী হয়ে আসেন টেকনাফ থানায়। তৎসময়ে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ নানা কারনে এলাকাটি অনেকটা দুর্গম ও ভয়ংকর জায়গা হিসেবে পরিচিত ছিলো।

আর সেই দুর্গম জায়গাতেই একদিন বদলী হয়ে আসেন ধীরাজ ভট্টাচার্য নামে এক পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁর বাড়ি কলকাতায়।

ধীরাজ যেহেতু আত্মীয় স্বজনহীন সেহেতু প্রায় সময় একাকী সময় কাটাতে হতো তাঁকে।

কাজের ফাঁকে প্রায় সময় থানার বারান্দায় আনমনা হয়ে চেয়ারে বসে থাকতেন ধীরাজ বাবু। স্থানীয়দের মুখে শুনা জনশ্রুতি আর এলাকার প্রবীণ লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, পুরো টেকনাফজুড়ে একমাত্র পাতকুয়া ছিলো থানা কম্পাউন্ডে।

বিশাল সেই কূপে পানি নিতে আসতো মগ সম্প্রদায়ের সুন্দরী তরুণীরা। রং বেরংয়ের আকর্ষনীয় পোষাক পড়ে পাতকুয়া থেকে কলসী হাতে পানি নিতে আসা এসব সুন্দরী যুবতীর মৃদুকন্ঠে ভেসে আসা সুরলা মধুর গানে মুগ্ধ হন থানার অফিসার ইনচার্জ।

শুধু তাই নয়, সেখানে ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সী সুন্দরী তরুণীরা বেশ ভালই আড্ডা জমাতো। যাদের মধ্যে খুব আকর্ষনীয় ছিলো স্থানীয় মগ জমিদার ওয়ানথিনের একমাত্র রূপবতী কন্যা মাথিন।

আর সেই মাথিনকে দেখেই মনে মনে ভালবেসে ফেলে ধীরাজ। এরপর থেকে প্রতিদিন ভোর সকালে থানার বারান্দায় বসে মাথিনের আসা-যাওয়া দেখার এক ফাঁকে দু’জনার মাঝে ঘটে যায় হৃদয় দেয়া নেয়ার ঘটনা। সম্ভব অসম্ভব নানা জল্পনা-কল্পনার স্বপ্ন জালে আবদ্ধ হয় ধীরাজ এবং মাথিন। কিন্তু মন দেয়া নেয়ার কিছুদিন যেতে না যেতেই কলকাতা থেকে হঠাৎ একদিন ধীরাজের কাছে ব্রাহ্মণ পিতার জরুরী টেলিবার্তা আসে। যেখানে তাঁর বাবা লিখেছেন, ‘খুব জরুরীভাবে এক মাসের ছুটি নিয়ে তাঁকে কলকাতা যেতে হবে’। এমনকি ছুটি না মিললে চাকরি এস্তেফা দিয়ে হলেও কলকাতা যাবার নির্দেশ দেন বাবা। টেলিগ্রাম পেয়ে টেকনাফ থেকে দ্রুত বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন পুলিশ অফিসার ধীরাজ। যদিও মাথিন কোনভাবেই ধীরাজকে যেতে দিতে চাননা। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে এক সন্ধ্যায় গোপনে টেকনাফ ছেড়ে পালিয়ে যান প্রেমিক ধীরাজ। সেই থেকে প্রিয়তম মানুষটির হঠাৎ প্রস্থানকে সহজভাবে মেনে নিতে পরেননি জমিদার কন্যা। এরিমধ্যে দিন, মাস, বছর যায় ফিরে আসেনা মাথিনের সখা প্রাণের ধীরাজ। এদিকে ভালবাসার প্রিয় মানুষটি ফিরে না আসায় অনাহার-অনিদ্রায় দিন গুনতে থাকে জমিদার কন্যা মাথিন। বিচ্ছেদের যন্ত্রনায় এক সময় মাথিন ঢলে পড়ে মৃত্যুর কুলে।

বিষাদের কষ্ট আর বেদনা-বিধুর প্রেমের উপাখ্যানের বহুল আলোচিত সেই ঘটনার কালজয়ী সাক্ষী আজকের ঐতিহাসিক মাথিনের কূপ। যা এখনো আকর্ষনীয় হয়ে আছে সীমান্ত উপজেলার টেকনাফ থানা কম্পাউন্ডে। সেই থেকে পাতকুয়াটির নামকরণ হয় অমর প্রেমের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক “মাথিনের কূপ”।

অন্যদিকে ধীরাজ ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত জীবনী নিয়ে লেখা “যখন পুলিশ ছিলাম” গ্রন্থে তারই ভালবাসার স্মৃতি আদরিনী মাথিনের কথা লিখেছেন বেশ স্বযতেœ। ১৯৩০ সালের পহেলা আষাড় লাহোরের ওবাইদুল্লাহ রোডের জিলানী ইউনিক প্রেস থেকে বইটি প্রকাশিত হয়। বইয়ের বিখ্যাত চরিত্রে মাথিনের কূপ সংশ্লিষ্ট কাহিনীটি স্পষ্টভাবে রচিত রয়েছে। তবে ভালবাসার জন্য রাখাইন জমিদার কন্যা মাথিনের এই জীবন বিসর্জনের ঘটনাটি মানতে রাজি নন টেকনাফের রাখাইনরা। তাদের দাবী, মাথিন কূপের এই প্রেমকাহিনী সাহিত্যিক পুলিশ অফিসার ধীরাজের লেখা উপন্যাসের কাল্পনিক চরিত্রের ইতিহাস মাত্র। এ নিয়ে বিভ্রান্ত হবার কারন নেই।

স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, অমর প্রেমের বেদনা বিধুর এই ইতিহাস জানতে প্রতি বছর দেশ-বিদেশ থেকে প্রায় ৮ লাখ পর্যটক টেকনাফের ঐতিহাসিক এই মাথিনের কূপ দেখতে আসেন। আর এ কূপকে ঘিরে আশপাশে গড়ে উঠেছে পর্যটক নির্ভর বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও।

প্রসঙ্গত : ১৯৮৪ সালের ২৪ এপ্রিল প্রথম টেকনাফ থানা কম্পাউন্ডে মাথিনের কূপের ইতিহাস সম্বলিত একটি সাইনবোর্ড ঝুলানোর উদ্যোগ নেন ওই এলাকার কৃতি সন্তান ও দেশের শীর্ষ সংবাদপত্র দৈনিক প্রথম আলোর কক্সবাজার অফিস প্রধান সিনিয়র সাংবাদিক আব্দুল কদ্দুস রানা। এরপর ২০০৮ সালের দিকে প্রায় ২৬ লাখ টাকা ব্যায়ে মাথিনের কূপটি আধুনিকায়ন করার উদ্যোগ নেন কক্সবাজারের তৎকালিন পুলিশ সুপার (বর্তমান ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার।

পরবর্তীতে ২০১২ সালের ৪ মার্চ তৎকালিন পুলিশ সুপার (বর্তমান ডিআইজি) সেলিম মো. জাহাঙ্গীর পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্যের একটি ভাস্কর্য স্থাপন করেন। যেটি মাথিনের কূপ দেখতে আসা দেশী-বিদেশী পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে সহজেই।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও জেলা পুলিশের মুখপাত্র আফরুজুল হক টুটুল জানান, পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজের অমর প্রেম কাহিনী ও তাঁর স্মৃতি বিজড়িত এই কূপটির সৌন্দর্য্য রক্ষার্থে টেকনাফ থানা কম্পাউন্ডকে প্রশাসনিকভাবে সব সময় নজরদারীতে রাখা হয়। কারন এটি ঐতিহাসিক এবং অমর ভালবাসার অনন্য এক নিদর্শন।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।
ফোন : ০১৮১৮-১৩১৩৩৭